Friday, July 22, 2016

কথা শুনুন, সঙ্গ দিন, ১০ ডলার নিন

জাপানে এক ভদ্রলোক দারুণ একটা ব্যবসা খুলেছেন। তা হচ্ছে, মানুষের কথা শোনা। যিনি বলবেন, তিনি বয়স্ক কোনো নিঃসঙ্গ ব্যক্তি হতে পারেন, আবার হতে পারেন স্বপ্নভঙ্গ হওয়া কোনো তরুণ। তার কথা তিনি শুনবেন। তবে এ জন্য ওই ভদ্রলোককে নগদ টাকা দিতে হবে। এক ঘণ্টার জন্য ১০ ডলার। জাপানি মুদ্রায় যা ১ হাজার ইয়েন। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮০০ টাকা। আজ শুক্রবার বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে এমনটাই জানানো হয়েছে।
৪৮ বছর বয়সী এই ভদ্রলোকের নাম তাকানোবু নিশিমোতো। তিনি পেশায় মূলত ফ্যাশন কো-অর্ডিনেটর। অনেকটা শখের বশেই শ্রোতার ভূমিকায় আসা। পরে দেখলেন যে ব্যবসা মন্দ নয়। মাসে ৩০-৪০ জন খদ্দের পাওয়া যায়, যাদের কথা ঘণ্টা ধরে শুনে পকেটে কিছু অর্থ ফেলেন তিনি। খদ্দেরদের মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগই আবার নারী। এর মধ্যে ব্যবসায় প্রসারও ঘটেছে। সহযোগী হিসেবে প্রায় ৬০ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন, যাঁদের বয়স ৪৫ থেকে ৫৫। জাপানজুড়ে ছড়িয়ে আছেন তাঁরা। যোগাযোগের সহজ পথ হচ্ছে অনলাইন সার্ভিস। লগ ইন করে এসব ‘ওশান’ যে কাউকে ভাড়া করা যাবে। জাপানে মধ্যবয়সী ব্যক্তিদের একটু ঠাট্টা করে ‘ওশান’ বলা হয়।

নিশিমোতো জানিয়েছেন, এ কাজ করে তিনি আনন্দিত। যারা তাঁকে ভাড়া করে, বেশির ভাগই সঙ্গ পাওয়ার জন্য। দু-এক ঘণ্টার জন্য ভাড়া করে মনের কথা বলে। অশীতিপর এক বৃদ্ধা তাঁর নিয়মিত গ্রাহক। প্রতি সপ্তাহে এক ঘণ্টার জন্য তাঁকে ভাড়া করে স্থানীয় পার্কে হেঁটে বেড়ান। নিশিমোতো বলেন, ‘বলতে গেলে আমি তাঁর ছেলের মতোই।’
অন্য রকম খদ্দেরও আছে নিশিমোতোর। একজন মাছ শিকারি আছেন, যিনি মাছ ধরার অপেক্ষায় বসে থেকে থেকে হয়রান। সুনসান পরিবেশে নিঃসঙ্গতা কাটাতে তাঁকে ভাড়া করেন তিনি। একজন কলেজছাত্র আছেন, যিনি শো বিজনেসে কিছু করে খেতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু পরিবারের সমর্থন নেই। এতে তিনি হতাশ। এই হতাশা কাটাতে নিশিমোতোকে ভাড়া করেন ওই শিক্ষার্থী। আবার বসের সঙ্গে আচার-আচরণ নিয়ে সমস্যায় ভোগা খেত-মার্কা ব্যক্তিও তাঁকে ভাড়া করেন।

মানুষকে সঙ্গ দিলে বা কথা শুনলে যে টাকা পাওয়া যায়, এটা আমাদের দেশে অনেকের কাছেই বেশ মজার বিষয় বলে মনে হবে। যারা একটু আয়েশি, টাকা-পয়সাও আছে, তারা অনেকে জাপান যেতে উৎসাহী হবে। ভাববে, সেখানে গিয়ে ব্যবসাটা জমাতে পারলে মন্দ হয় না। মানুষের বকবক শুনে, এখানে-সেখানে ঘুরে বেরিয়ে টাকা কামানোর মতো আরাম আর কিসে আছে?
হ্যাঁ, নিশিমোতোর জন্য এভাবে আয়-রোজগার আনন্দদায়ক হলেও তা কিন্তু জাপানি সমাজের একটি করুণ চিত্রকে তুলে ধরছে। সেখানে অঢেল বিত্ত-বৈভবের মধ্যে থেকেও মানুষ কতটা নিঃসঙ্গ, এখানে তা সুস্পষ্ট। স্কুলের বালক-বালিকা থেকে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধ পর্যন্ত অনেক মানুষই সেখানে একা। কেউ একলা ঘরে থেকে নিঃসঙ্গ, কেউবা অনেক মানুষের ভিড়ে থেকে সঙ্গীহীন।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশ্বের শীর্ষ কাতারে থাকা ধনী দেশ জাপানে কিশোর বয়সী ও তরুণ-তরুণীরা ইদানীং নিঃসঙ্গ হচ্ছে নিজেদের কারণে। জাপানিরা এমনিতে কেতাদুরস্ত থাকতে পছন্দ করে। সামাজিক মেলামেশা থাকে মাপজোখের ভেতর। আজকাল তা বেড়ে গেছে। কৈশোর-তারুণ্যে থাকা ছেলেমেয়েরা এখন অনেকটাই অন্তর্মুখী। বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশার চেয়ে ঘরে বসে ভিডিও গেম বা এ ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর বিনোদনে মগ্ন থাকে।

জাপানের একজন মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, সেখানে সামাজিক নর্মটাই এমন, একজন নাগরিকের মধ্যে এমনভাবে ‘আমিত্ব’ তৈরি হয়, সে আর অন্যদের সঙ্গে সহজে অন্তরঙ্গভাবে মিশতে পারে না।
জাপানে ৩৩ শতাংশ মানুষের গড় আয়ু ৬০ বছরের ওপরে। সে দেশে শতায়ু ব্যক্তিও আছেন বেশ কয়েকজন। এসব বর্ষীয়ান ব্যক্তি খাওয়া-পরার দিক দিয়ে বিশ্বের অনেক দেশের মানুষের চেয়ে স্বচ্ছন্দে আছেন। কিন্তু মনের ভেতর গুমরে মরে একলা থাকার যন্ত্রণা।

বাংলাদেশি মানুষেরও গড় আয়ু এখন বেড়েছে। আশি ও নব্বইয়ের ঘরে থাকা ব্যক্তি হরহামেশাই চোখে পড়ে। কিন্তু তাঁরা বেশির ভাগই নিঃসঙ্গ নন। আমাদের সামাজিক বন্ধনটাই এমন, শত কাজ ও ব্যস্ততার মধ্যেই একটি ছেলে বা মেয়ে তার বাবা-মায়ের খোঁজখবর ঠিকই রাখে। আপনজনের একটু সান্নিধ্য পেতে এ দেশের মানুষ কেমন ব্যাকুল থাকে, ঈদে ঘরমুখী মানুষের স্রোতের মতো ধাই করা তা প্রমাণ করে। জীবনে সাফল্য পেতে বাবা-মায়ের এবং মুরব্বিদের দোয়ার জন্য ভক্তির দুয়ার অবারিত রাখে মানুষ।

এরপরও শহুরে সমাজে আজকাল কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। বেশির ভাগই তা সচ্ছল পরিবারে। যেখানে একটি শিশু কিছু চাইলেই তা সহজে পেয়ে যায়, বাইরের উদার প্রাকৃতিক পরিবেশে বিচরণের সুযোগ না পেয়ে ঘরের ভেতর একলা ভুবন তৈরি করে নেয়, আধুনিক সব গেজেট হয় তার বিনোদনের উৎস, সহানুভূতির বদলে সহপাঠীদের সঙ্গে গড়ে ওঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্পর্ক, এসব শিশু স্বার্থপর হয়ে উঠছে বাবা-মায়েরই অগোচরে। সময় থাকতে এ ব্যাপারে আপনজনদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমরা চাই না, এমন দিন আসুক, যখন বড় হয়ে এসব শিশুর বাবা-মা ঘণ্টা চুক্তিতে একজন শ্রোতা ভাড়া করবে। কিংবা এই শিশুরাই অনলাইনে ঘেঁটে খুঁজে দেখবে সঙ্গ দেওয়ার মতো কেউ আছে কি না।

No comments:

Post a Comment