কল্যাণপুরে সশস্ত্র জঙ্গি দলের আস্তানায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বিশেষায়িত টিম স্পেশাল উইপন্স অ্যান্ড ট্যাকটিসের (সোয়াট) সফল 'অপারেশন স্টর্ম-২৬' পুলিশের মনোবল অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০০৮ সালে সোয়াট গঠনের পর এটিই ছিল সশস্ত্র কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে এই ইউনিটের সবচেয়ে 'ক্লোজ ফাইটিং অপারেশন'। এর আগে মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে জঙ্গি আস্তানায় সোয়াট অভিযান চালালেও কাছে গিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় তাদের মোকাবেলা করতে হয়নি। এ ছাড়া আগের অভিযানগুলো সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চালানো হয়েছিল। কল্যাণপুরের অভিযান চালানো হয় তাৎক্ষণিকভাবে। এরপরও ক্লোজ ফাইটিংয়ে প্রশিক্ষিত ও সশস্ত্র ৯ জঙ্গিকে প্রতিহত করে সোয়াট। এ অভিযানে সোয়াটের প্রশিক্ষিত ৫০ সদস্যের মধ্যে ৩৫ জন অংশ নেন। তারা সবাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
এটি শুধু সোয়াট নয়, পুলিশ বাহিনীর ইতিহাসে অন্যতম সফল অপারেশন। প্রতিকূল পরিস্থিতি ও ঝুঁকির মধ্যে থেকেও সফল এ অভিযানে পুলিশের সক্ষমতার বিষয়টিও সামনে আসছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বাহিনীর মনোবল বাড়ানোর পাশাপাশি এ অভিযানের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে কাজে আসবে।
কল্যাণপুরের ৫ নম্বর রোডের 'জাহাজ বিল্ডিং' নামে পরিচিত তাজ মঞ্জিলের পঞ্চম তলায় ছিল জঙ্গিদের আস্তানা। বাড়িটি বিশাল হলেও ভেতরের সিঁড়ি খুবই সরু। স্বাভাবিকভাবে ওই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে বেগ পেতে হয়। ওই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গত মঙ্গলবার সোয়াট সদস্যদের অভিযান চালাতে হয়েছিল। অভিযানের আগে নানা ঝুঁকির কথা বিবেচনা করতে হয়। ওই বাড়ির চারদিকেই রয়েছে আবাসিক ভবন। এ ছাড়া জঙ্গি আস্তানার ওপরে এবং নিচের বিভিন্ন তলায় বাসিন্দারা ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে অভিযানে গেলে সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ কারণে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটটি দ্রুত ঘটনাস্থলে পেঁৗছলেও অভিযান চালানোর জন্য যথেষ্ট সময় নেওয়া হয়। ভোরের আলো ফুটতেই ৫টা ৫১ মিনিটে শুরু হয় অভিযান। ৬টা ৫১ মিনিটে সফল এই অভিযানটি শেষ হয়।
পুলিশ জানায়, এ অভিযানে ৪০০ রাউন্ড গুলি ব্যবহার করতে হয়েছে। সোয়াট সদস্যরা সরু সিঁড়ি বেয়ে পঞ্চম তলায় ওঠার সময় জঙ্গিরা গুলি ছোড়ে ও বোমা মেরে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে। প্রতিরোধ গড়তে না পেরে তারা দরজা বন্ধ করে দেয়। বিশেষ ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করে দরজা ভাঙতে হয়েছে। তারপর বিশেষ ধরনের বুলেটপ্রুফ ঢাল ব্যবহার করা হয়। দু'দিক থেকে দু'জন এই ঢাল ধরে এগুতে থাকে। আর মাঝখানে একজন গুলি করতে করতে সামনের দিকে অগ্রসর হন। অপারেশনে সোয়াট সদস্যদের পেছনে থেকে ডিবির চৌকস একটি দল ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা সহায়তা করেন।
অভিযানে থাকা কাউন্টার টেররিজমের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, সোয়াট সদস্যরা দুই দিক থেকে অ্যাসল্ট রাইফেল আর স্নাইপার দিয়ে আক্রমণ শুরু করে। এক পর্যায়ে জঙ্গিরা পিছু হটে দরজা বন্ধ করে দেয়। তবে অভিযানিক দলের অ্যাসল্ট রাইফেলে সবকিছুই গুঁড়িয়ে যায়। তাদের সব কিছুই হার মানে 'স্টর্ম-২৬'-এর কাছে।
পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য ছিল না। নিয়মিত অভিযানের সময় জঙ্গিরা থানা পুলিশের ওপর হামলা করে। এ সময় পালানোর সময় এক জঙ্গিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করা হয়। ওই সময় ৯ জঙ্গি ভেতরে আটকা পড়ে। আটক জঙ্গির দেওয়া তথ্যে জানা যায়, জঙ্গিদের কাছে গ্রেনেড, অস্ত্র ও অন্যান্য বিস্ফোরক রয়েছে। সেখান থেকে তারা পুলিশের ওপর হামলার হুমকি দিচ্ছিল। কখনও কখনও তারা ভেতর থেকে গুলিও ছুড়ছিল।
সশস্ত্র জঙ্গিরা আস্তানার ভেতরে আটকা পড়ার পরই সোমবার রাত আড়াইটার দিকে ঘটনাস্থলে পেঁৗছে যায় সোয়াট ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। কিছুক্ষণ পর আস্তানার ভেতরে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তারা গ্যাসের লাইনে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে_ এ আশঙ্কায় ওই বাড়ি ও আশপাশের বাসা-বাড়িতে গ্যাসের সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
বাড়ির পঞ্চম তলায় গড়ে ওঠা জঙ্গি আস্তানাটি রাত সাড়ে ১২টার পর থেকেই ঘিরে রাখেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। দফায় দফায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, অভিযান চালানো হবে দিনের আলোয়। এরপর সোয়াট ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা পুরো এলাকা রেকি করেন। এর পরই সোয়াট ভবনগুলোর অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযান পরিচালনার কৌশল ও প্রস্তুতি, জঙ্গিদের অবস্থান ও সামর্থ্য, স্থানীয় বাসিন্দা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে মৌখিক প্রতিবেদন দেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। আটক রাকিবুল হাসানের কাছ থেকেও আস্তানাটি সম্পর্কে ধারণা নেন গোয়েন্দারা। ওই ভবনের চারপাশের ভবনের ছাদে অবস্থান নেন পুলিশ সদস্যরা। এতে সহযোগিতা করে র্যাবও।
No comments:
Post a Comment