গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে নৃশংস হামলা চালিয়েছিল যেসব জঙ্গি, তাদের প্রশংসা করে ভবিষ্যতে আরও হামলার হুমকি এসেছে কথিত ইসলামিক স্টেট থেকে। এই ইসলামিক স্টেটের কেন্দ্র হচ্ছে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাকা প্রদেশ। সিরিয়া-ইরাক সীমান্তের এক বিরাট অংশজুড়ে এখন ইসলামিক স্টেটের যে কথিত রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ২০০৩ সালের আগে সেখানে এ রকম কিছু ছিল না। তখন মসুল ছিল সাদ্দাম হোসেনের রাজত্বের অংশ। আর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ তো আরও পরের কথা। ২০০৩ সালে ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের কাছে কথিত গণবিধ্বংসী অস্ত্র (উইপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশন, ডব্লিউএমডি) থাকার গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বকে বিপদমুক্ত করার ব্রত নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। প্রেসিডেন্ট বুশ ও প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সর্বনাশা বন্ধুত্ব সেদিন জাতিসংঘকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইরাকে সরকার বদলের যে সামরিক অভিযান চালিয়েছিল, তার রেশ আজও কাটেনি। সেই ধ্বংসের উন্মাদনা আজ বিস্তৃত হয়েছে ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও। রাকা থেকেই বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের হুমকি উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু সেই ইরাক আগ্রাসনের ঠিক ১৩ বছর পর ব্রিটেনের এক সরকারি তদন্তে এখন স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে, ইরাকে ডব্লিউএমডির গোয়েন্দা তথ্য ছিল ত্রুটিপূর্ণ এবং সামরিক অভিযান পরিচালনার যুক্তিগুলো মোটেও সন্তোষজনক ছিল না।
টনি ব্লেয়ারের উত্তরসূরি গর্ডন ব্রাউন এই তদন্তের উদ্যোগ নেন এবং স্যার জন চিলকটের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন সাত বছর ধরে শুনানি অনুষ্ঠান, সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ের পর ৬ জুলাই বহুল প্রত্যাশিত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। প্রায় আট হাজার পৃষ্ঠার ২৬ লাখ শব্দের এই বিশাল প্রতিবেদনে হাজার হাজার অপ্রকাশিত রাষ্ট্রীয় ও গোপন নথিপত্র প্রথমবারের মতো প্রকাশ করা হয়েছে। এগুলোর বিস্তারিত খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা বিতর্ক চলবে আরও অনেক দিন। তবে এই যুদ্ধের অন্যতম হোতা টনি ব্লেয়ার এখন স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন যে, গোয়েন্দা তথ্যের সঠিকতার বিষয়ে তাঁর উচিত ছিল আরও প্রশ্ন করা। তিনি এই যুদ্ধের ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের কাছে দুঃখপ্রকাশ করেছেন এবং ক্ষমাও চেয়েছেন। তবে তিনি দাবি করেছেন, তিনি সজ্ঞানে কাউকে বিভ্রান্ত করেননি এবং সরল বিশ্বাসে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে তিনি সাংবাদিকদের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েই গেছে। যুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ সেনাদের পরিবারবর্গের অনেকে সে রকম ইঙ্গিতই দিয়েছেন।
পাঠকদের অনেকেরই মনে থাকবে টনি ব্লেয়ারের সেই বিখ্যাত বিবৃতি যাতে তিনি বলেছিলেন, সাদ্দাম হোসেন ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে তা ৪৫ মিনিটের মধ্যে ইউরোপে আঘাত হানতে পারে। সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা ও বিকলাঙ্গ করে দিয়েছেন। তাঁকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না এবং কোনো সুযোগ দেওয়া চলে না। মি. ব্লেয়ার এগুলো বলেছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। কিন্তু বিভিন্ন নথিপত্র ও সাক্ষ্যপ্রমাণ যাচাই করে চিলকট কমিশন মোটাদাগে যেসব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে সেগুলো হচ্ছে এ রকম:
এক. ২০০৩ সালের মার্চ মাসে সাদ্দাম হোসেন এমন কোনো হুমকি ছিলেন না যাতে তখনই সামরিক অভিযান চালাতে হতো। ভবিষ্যতে সামরিক অভিযান প্রয়োজন হলেও তখন তার প্রয়োজন ছিল না।
দুই. ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্রসম্ভার ও সামরিক ক্ষমতা সম্পর্কে মি. ব্লেয়ার যে বিবরণ এবং কথিত নথি (ডোশিয়ার) যতটা নিশ্চিতভাবে প্রকাশ করেছিলেন, তা মোটেও যৌক্তিক ছিল না।
তিন. সামরিক অভিযানের বিষয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার পরও যুক্তরাজ্য যে অবস্থান গ্রহণ করেছিল, তাতে নিরাপত্তা পরিষদের গুরুত্বকে খাটো করা হয়েছে বলে কমিশন মনে করে।
চার. যে পরিস্থিতিতে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তার আইনগত ভিত্তি সম্পর্কে কমিশন মনে করে যে তা সন্তোষজনক ছিল না।
পাঁচ. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক যথেষ্ট দৃঢ় হিসেবে প্রমাণিত এবং তাতে ভিন্নমত গ্রহণযোগ্য। সুতরাং, আমাদের স্বার্থ অথবা বিবেচনায় ভিন্নতা সত্ত্বেও নিঃশর্তভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থনের প্রয়োজন ছিল না।
ছয়. আমরা মনে করি যে শান্তিপূর্ণভাবে ইরাককে নিরস্ত্র করার উপায়গুলো কাজে লাগানোর আগে যুক্তরাজ্য যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সুতরাং, সে সময়ে যুদ্ধটাই শেষ উপায় ছিল না।
সাত. যুদ্ধোত্তর ইরাকের পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জটি যেই মাত্রায় ছিল তা মোকাবিলায় যুক্তরাজ্য সেই মাত্রায় চেষ্টা করেনি।
টনি ব্লেয়ারকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করা যায় কি না, এ রকম একটি সিদ্ধান্ত যাঁরা আশা করেছিলেন তাঁদের জন্য স্যার চিলকটের ব্যাখ্যাটি ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, আইনগত বিচার বা মতামত দেওয়ার দায়িত্বটি তাঁদের ছিল না। তবে, যুদ্ধের জন্য যে আইনগত যৌক্তিকতা মি. ব্লেয়ার তুলে ধরেছিলেন তাকে ‘সন্তোষজনক নয়’ অভিহিত করার মধ্যেই এর উত্তরটি নিহিত। আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, মি. ব্লেয়ারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যুদ্ধে হতাহত ব্রিটিশ সেনাসদস্যদের পরিবারগুলোর সদস্যরা চিলকট রিপোর্ট প্রকাশের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সে রকম ইঙ্গিতই দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, রিপোর্টটি বিশদভাবে খুঁটিয়ে দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আইনগত বৈধতার বিষয়ে মি. ব্লেয়ারের জন্য আরেকটি বড় মাথাব্যথার কারণ হবে কমিশনের এই উপসংহার—সিদ্ধান্তটি মন্ত্রিসভার ছিল না, ছিল প্রধানমন্ত্রীর।
ব্রিটিশ রাজনীতি, সরকার পরিচালনার রীতিনীতি, গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকলাপ—সবকিছুর ওপরই চিলকট কমিশন রিপোর্টের একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। কিন্তু, একই সঙ্গে তা ইঙ্গ-মার্কিন জোটের বৈশ্বিক নীতি ও কৌশলের যথার্থতা বিষয়ে বাকি বিশ্বকে ভবিষ্যতে আরও সতর্ক ও সন্দিহান করে তুলবে।
Pages
▼
▼
No comments:
Post a Comment